১
ঢাকায় শাহ জালালের নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেটে শাহ জালালের নামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আসলে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে এই নামগুলো থাকার নৈতিক কোনো অধিকার আছে? শাহ জালাল সাহেব এমন কি বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ ছিলেন যে, তাঁর নামে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও গোটা একটা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে হবে? তিনি তো বাঙালিও ছিলেন না। বাংলার মাটিতেও জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি যা প্রচার করেছেন তা হলো আরব্য ধর্ম ও সংস্কৃতি। তো উনাকে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে এতো প্রাধান্য দেওয়ার কি আছে ভাই? উনি কি বিমান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন নাকি, উনার নামে বাংলাদেশে যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকতে হবে? উনি প্রকৌশলী ছিলেন নাকি, উনার নামে যে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করা হলো? বরঞ্চ উনি নিজের জীবদ্দশায় এই দেশে আরব্য ধর্ম ও ইসলামিক সংস্কৃতি প্রচার করে আমাদের বাঙালিয়ানার জাতিসত্তাকে মোটা দাগে ধ্বংস করে গিয়েছিলেন। চলুন আজ জানি, শাহজালাল সাহেব কে ছিলেন এবং কিভাবে সিলেটে এসেছিলেন---
১২ শতকের সময় মক্কার কোরাইশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। ঐ শাখার মোহাম্মদ বা মাহমুদ শাহজালালের পিতা। মাহমুদের পিতা ছিলেন ইব্রাহিম।
হযরত শাহ জালালের রওজায় প্রাপ্ত ফলক-লিপি সুহেলি ইয়েমেনি অনুসারে শাহ জালাল সাহেব ৩২ বছর বয়সে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট আগমন করেন। সুহেলি ইয়ামনিতে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে, ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে শাহজালাল জন্মগ্রহণ করেছেন। তার জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়েমেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে। শাহ জালাল যখন তিন মাসের শিশুবালক, তখনই তাঁর মাতার মৃত্যু হয়। শাহজালাল শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। তাঁর মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে আহমদ কবীর শাহ জালালকে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হোজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে শাহ জালালকেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।
শাহজালাল সাহেব ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৪০ জন ভক্ত নিয়ে ইয়েমেন থেকে সিলেটে আগমন করেন এবং আরবের ধর্ম ইসলামকে এই বাঙালির দেশে প্রচার করেন।
এখন কথা হলো, একটা জাতির নিজস্ব জাতিসত্তা হলো সেই জাতির আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও স্থাপত্য নির্মানগুলো। বাঙালি সংস্কৃতির প্রাগৈতিহাসিক স্থান ও প্রতীকগুলো হলো কুমিল্লার ময়নামতিতে মহাস্থানগড়, সীতাকুণ্ড, আদিনাথ, সোমনাথ, চন্দ্রনাথ পাহাড়, ঢাকেশ্বরী মন্দির, মেধসমুনি আশ্রম সহ আরো অনেক স্থাপনা আছে যেগুলি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতীক। আর আরবরাষ্ট্র ইয়েমেন থেকে এসে হজরত শাহ জালাল সাহেব যেগুলি প্রচার করেছেন, সেগুলি বাঙালির ধর্মও না, বাঙালির সংস্কৃতিও না, বাঙালির জাতীয়তাবাদও না। তো সেই হিসেবে বাংলাদেশে শাহ জালালের নামে বিমান বন্দর থাকা মানে এটা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অবমাননা করা নয় কি?
২
আজ রোজ বুধবার, ২০ই ডিসেম্বর ২০২৩ইংরেজি। আজ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম নির্বাচনী প্রচার সিলেটে থেকে শুরু করছেন। কারণ সিলেটে হজরত শাহ জালালের মাজার আছে। তাই এখান থেকে তিনি ১ম নির্বাচনী প্রচারটা করতে চান। এখন কথা হলো বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী যখন বাঙালি সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ ও ঐহিত্যকে পেছনে রেখে ইয়েমেন থেকে আসা হজরত শাহজালালের ইসলামিক রীতিনীতিকে প্রোমোট করছেন, তখন বুঝতে হবে তিনি এইদেশের মুসলমানদের আসলেই ভাল চান না। সেই জন্য তিনি আবার ধর্মীয় রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছেন। সিলেটবাসী তথা পুরো বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমি জানতে চাই, একজন প্রধানমন্ত্রী যদি তার রাজনীতিতে আরব্য ধর্ম প্রচারক শাহ জালালকে প্রোমোট করে, তাহলে আপনাদের জীবনের কি উন্নতিটা হবে একটু শুনি? আপনাদের কাছে আরো জানতে চাই, আমাদের জীবন যাত্রায় চলতে গেলে এখন কি কি প্রয়োজন? মাদ্রাসা শিক্ষা, দরবেশদের মাজারে যাওয়া আসা নাকি বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান ও শিক্ষা? কখনো শাহ জালালের নামে ধর্মীয় সুড়সুড়ি, কখনো আরবের ধর্ম প্রবর্তক নবী মোহাম্মদের নামে ধর্মীয় সুড়সুড়ি পেয়ে, গুজবে মেতে উঠে দিনশেষে আপনাদের লাভটা কি হলো ভাই? কিছুই তো হলোনা। বরঞ্চ ধর্মের নামে আপনার কাছ থেকে ভোট নিয়ে আপনাকে বোকা বানিয়েছে ভাই। আপনি কেন শেখ হাসিনার প্রচার অনুযায়ী শাহ জালালের ভক্ত হবেন? কেন শেখ হাসিনাকে একজন বাংলাদেশী ইসলামিক নেত্রী মনে করবেন? এটা তো আপনার ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আপনার ভোট হাতিয়ে নিচ্ছেন নেতা নেত্রীরা। আপনি তো নিজে চাইলেও শাহ জালালের দরবারে গিয়ে মুরিদ হতে পারেন ভাই। আপনি চাইলেও শাহ জালালের জীবনী পড়ে তাঁকে জানতে পারেন। এই নিয়ে তো বাংলাদেশ সংবিধানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ধর্ম তো আপনার অন্তরের ব্যক্তিগত অনুভূতি। সেই অনুভূতি কি আপনার কাছ থেকে কেউ কখনো কেড়ে নিতে পারবে ভাই?
আমাদের বেঁচে থাকতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রযুক্তি। আপনার যদি আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত বিদ্যা থাকে, তাহলে আপনি পরিবার নিয়ে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে গিয়ে নিজের জীবন পরিচালিত করতে পারবেন। কিন্তু আরব্য ধর্ম ও সংস্কৃতির মাদ্রাসা শিক্ষা দিয়ে সেটা কখনোই পারবেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর। সেই হিসেবে এই ৫২ বছরে আমাদের অর্জনটা আসলে কি? পদ্মা সেতু? বঙ্গবন্ধু টানেল? শীতকালীন ওয়াজ মাহফিল? আরে ভাই তুর্কিতে গিয়ে দেখেন, সেখানে ৫০ বছর আগেই পানির ভিতর কয়েক কিলোমিটারের টানেল বানানো হয়েছে। আর পাশের দেশ ভারতে দেখেন, তারা ক্ষমতায় আসে ১৪২ কোটি জনগণ প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি পুরন করে। গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতীয় জনগনকে কি দেয়নি? ৮০ কোটি জনগনকে রেশনের ব্যবস্থা করেছেন। কৃষকদের ঋণ মওকুফ করেছে। প্রতটি পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকার সঞ্চয় দিচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই সুবিধা দিনশেষে হিন্দু-মুসলিম সবাই পাচ্ছেন। আর ভারত গত ১০ দশ বছরে প্রযুক্তিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, সেখানে আমাদের পৌঁছাতে ১০০ বছর লাগবে। আর আমাদের রাজনীতিবিদরা পড়ে আছে ইয়েমেন থেকে আসা হজরত শাহ জালালদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠ গরম করছেন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, বেঁচে থাকার তাগিদে আপনার অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রয়োজন নাকি মিথ্যাবাদী রাজনীতিবিদদের আরব্য ধর্মের সুড়সুড়ি পাওয়া প্রয়োজন? জীবন আপনার, সিদ্ধান্তও আপনার।
অবশেষে বলি, ইয়েমেন থেকে আসা হজরত শাহ জালাল বর্তমান আমাদের বাঙালি জাতির কাছে কোনো গুরুত্বই বহন করেনা। কারণ উনার মধ্যে বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটাও ছিলো না। তো উনার নামে কেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের স্থাপত্য থাকবে? আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার কাছে গুরুত্ব বহন করে একজন শিক্ষাবিদ ও দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসিন, আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। আমাদের কাছে গুরুত্ব বহন করে এই শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি বিজ্ঞানি ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম খানের থিওরি। শাহ জালালের মতো একজন আরব্য ধর্ম ইসলাম প্রচারক মানুষ কখনো আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয় হতে পারেনা। উনি সিলেটে এসেছিলেন আরব্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ প্রচার করতে। সেই নিয়ে আমার আপত্তি নেই, আমার আপত্তি হলো একজন আরব থেকে আসা দরবেশের নামে আমাদের বাঙালির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম থাকবে কেন? বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের জন্য উনি কি অবদান রেখেছিলেন?