সুফিয়া ডেইজি -গল্প

সুফিয়া ডেইজি -গল্প

মোমিনুলের দুষ্টুগিরি

মোমিনুল শুধু চঞ্চল ই নয় ভীষণ রকম দুষ্টু এবং অত্যাচারী বললে কম হয়ে যায়। বাবা মা'র একমাত্র আদূরে ছেলে আর অনেক টাকা পয়সা ওয়ালা দাদুর একমাত্র নাতি হবার জন্য বাড়ির সবাই অনেক বেশি সহ্য করে মোমিনুলের দুষ্টুপণা।আর এজন্যই মোমিনুলের সেচ্ছাচারিতার মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। আজকের কান্ডটা নিশ্চয় ছোট নয়! মুজাহিদ আর আহাদ কে ইচ্ছে করে ই সিঁড়িতে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল। নেহাতই স্কুল তাই সবার ভিড়ে খুব একটা বেশি আঘাত পায় নাই কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো।  প্রত্যেক টা দিন এই রকম কর্মকাণ্ড মোমিনুলের জন্য একটা সাধারণ ব্যাপার। 

 দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটির পরে রবিবার স্কুলে এসেই দূর থেকে দেখি বেশকিছু অভিভাবক ভীষণ চিল্লাপাল্লা করছেন।হেড ম্যাম সহ জলিল স্যার আর দবির স্যার খুব বোঝানোর চেষ্টা করছেন।আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে ভিড়ের মাঝে এসেই বুঝেছি এটা নতুন কিছু নয় গত বৃহস্পতিবারের জের।তাই মুজাহিদ আর আহাদের বাবা-মা সহ অন্যান্য মানুষ কে অনুরোধ করে অফিসকক্ষে নিয়ে আসলাম।চা বানাতে দিয়ে সাভাবিকভাবে কুশল বিনিময় করলাম তারপর চায়ের কাপ হাতে দিয়ে চা খেতে খেতে বাচ্চামানুষের আচরণের প্রতি আমাদের সব সময় নিয়ন্ত্রণ থাকে না সেটা বোঝানোর মাধ্যমে গত বৃহস্পতিবারের ঘটনাটি ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম এবং উনারা শান্ত হয়ে বাসায় ফিরে গেলেন।তারপর মোমিনুলের দাদা এবং বাবা কে অনুরোধ করলাম বাচ্চাকে ভালোবাসুন কিন্তু বাচ্চার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না প্লিজ।শিশুকে আদর ভালোবাসার সাথে চাহিদায় লাগাম দিতে হয় নিশ্চয় সে কথা আমার চেয়ে আপনারা ভালো জানেন।

যাইহোক ক্লাসে যাবার সময় হয়ে গিয়েছে আমি আসি।

ক্লাসে গিয়েই  প্রথম চোখ খুঁজে মোমিনুলকে আর দেখা পাই সেভাবেই নিজের বসার সিট ছাড়া অন্য জায়গায়। সবাইকে নিজের সিটে ভালো ভাবে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম একটা গল্প শুনবে? সবাই উচ্চ স্বরে হ্যাঁ বলল।শোনো ডোরেমন নামে একটা কার্টুন ছিলো ইউটিউবে সার্চ দিলে দেখতে পাবে তার সামান্য একটা অংশ বলি,সেখানে নবিতা নামে তোমাদের বয়সি একটা চঞ্চল শিশু ছিলো সে সব সময় বিভিন্ন দুষ্টু দুষ্টু কর্মকাণ্ড করে বেড়াতো আর দুষ্টু কাজ তো ভালো নয় এজন্য তার কাজে অন্যের ক্ষতি হতো কিংবা ভুল হয়ে যেতো তখন তার একটা অনেক অনেক প্রিয় বন্ধু যার নাম ডোরেমন তার ভুলের জন্য অনেক রাগ করতো। কিন্তু মজার বিষয় হলো ডোরেমন জাদুর মতো সব কাজ ঠিক করে দিতে পারতো। আর সেজন্য ই  বারবার নবিতা ভুল করে আবারও সঠিক কাজের জন্য ডোরেমনের সাহায্য নিতো কিন্তু ডোরেমন তো রাগ করে থাকতো নবিতার দুষ্টুমির জন্য তখন নবিতা বারবার আদর করে ডোরেমনকে সরি বলতো  আর ততক্ষণ পর্যন্ত সরি বলে ডোরেমনের পিছ পিছ ঘুরতো যতক্ষণ ডোরেমনের রাগ না কমতো।এবার বলো কে কে কার্টুনের নবিতাকে পছন্দ করো হাত তুলে জানাও?ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ই হাত তুলে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায়। আমি হাত নামাতে বলে আবারও জিজ্ঞেস করি নবিতা যখন কোনো ভুল করে তখন ডোরেমন কে কিভাবে সরি বলে আবারও সাহায্য করতে বলতো কেউ অভিনয় করে দেখাতে পারবে? প্রথম লজ্জা পেলেও আমি অভিনয় করে দেখানোর পরে মোমিনুলসহ অনেকে ই নবিতার সরি বলার অভিনয়টুকু দেখালো।তারপর মুজাহিদ, আহাদ আর মোমিনুলকে আমার টেবিলের সামনে নিয়ে গত বৃহস্পতিবারের ভুলের জন্য মোমিনুলকে বললাম মুজাহিদ আর আহাদের হাত ধরে করমর্দন  করার মাধ্যমে সরি বলে গলায় জড়িয়ে ধরতে প্রথম রাজি হয় নাই কিন্তু পরে অনেক ভাবেই বুঝিয়ে খানিকটা জোর করে রাজি করালাম। তিনজনই মহা খুশিতে ক্ষমা বিনিময় করে আনন্দ পায়। 

একদিন হঠাৎ করে স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পড়ে ফাহিয়ার হাতে ভর দেয়া লাঠিটা সজোরে সিড়িতে পড়ে যায় ঠিক সেই সময় কোথা থেকে দৌড় দিয়ে মোমিনুল এসে ফাহিয়াকে ধরে পড়ে যাওয়া থেকে বাচিঁয়ে নেয়।শুধু তাই নয় ফাহিয়াকে দেয়ালের পাশে নিয়ে গিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়াতে বলে নিজে সিড়ি বেয়ে নিচ থেকে লাঠি টা কুড়িয়ে ফাহিয়াকে ধরিয়ে দেয়।সব সময় যে মোমিনুলের দুষ্টুমি আর চঞ্চলতার খারাপ দিক গুলো দেখি আজ হঠাৎ সেই মোমিনুলের এমন একটা ভালো গুণ দেখে অবাক হলাম। তারপর থেকে সারাক্ষণ মোমিনুলের প্রত্যেক টা দিনের কাজকর্ম মিলিয়ে একটা অংক কষার চেষ্টা করতে শুরু করলাম।মনের মধ্যে মোমিনুলের জন্য একটা কিছু করার দায়িত্ব ঘুরপাক করতে লাগলো। অহ আসল কথায় বলা হয় নাই। মোমিনুল অনেক ছোট, ক্লাস টু তে পড়ে আর গায়ের রং শ্যামলা পাতলা গড়ন ছাত্র হিসেবে খুব ভালো না হলেও মন্দ নয়।

একবার তার চঞ্চলতা আর দুষ্টুমি থেকে রেহাই পাবার জন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন বানাই। ব্যস মাত্র দুই দিন পর শুনি ক্লাসের অর্ধেক শিক্ষার্থীর সুস্থ শ্বাস নেয়ায় হারাম করে দিয়েছিলো অধিক মাতবরি করতে করতে। শোনা মাত্র হাত জোড় করে মাফ চেয়ে বলি বাপ তোমার আর ক্যাপ্টেন হয়ে কাজ নেই সাথে  হামকি ধামকি দিয়ে শাসন করে বন্ধ করি মোমিনুলের ক্যাপ্টেনগিরি।

একদিন স্কুলের সব শিক্ষার্থীদের স্কুল মাঠের গাছ তলায় একত্রিত করলাম এবং সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি একটা প্ল্যান করেছি সে প্ল্যান বাস্তবে কাজে লাগাতে হলে তোমাদের সবার সাহায্য আমার খুব দরকার তোমরা হেল্প করবে আমায়?সবাই এক যোগে উচ্চস্বরে বলে উঠলো হেল্প করবো ম্যাম।আমি তাদের ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বললাম যে আমার হাতে এই যে একটা জিনিস দেখছো এটা মাটির তৈরি একটা বড় ব্যাংক চেনো তোমরা?  কেউ কেউ হ্যাঁ বলেছে।আমি বললাম আমরা প্রতিদিন যে যখন পারবো এই ব্যাংকে এক দুই টাকা করে রাখবো তারপর যখন এই ব্যাংক ভর্তি হবে তখন আমরা একজন খুব অসুস্থ বাচ্চার চিকিৎসার জন্য এই টাকা গুলো দিবো কি রাজি তোমরা? সবাই হ্যাঁ বলল।আমি সবার সামনে ছোট্ট মোমিনুলের হাতে এই মাটির ব্যাংক টি দিয়ে বললাম মোমিনুল তুমি প্রতিদিন এই ব্যাংক টি নিয়ে সব ক্লাসেই টিফিন সময় একবার করে গিয়ে টাকা তুলে আসবে এবং কাউকে জোর করবে না যার ইচ্ছে দিবে আর ইচ্ছে না হলে দিবে না কি পারবে আমার এই দায়িত্ব টা পালন করতে?  মোমিনুল খুব আগ্রহ করে কাজটি নিজ কাঁধে নিয়ে নিলো।সেদিন মোমিনুলকে আলাদা করে একা একটি ঘরে  ডেকে নিয়ে বললাম,শোনো টাকা উঠানোর একটা পলিসি বলি প্রতিদিন সবার কাছে গিয়ে আদরের সুরে বলবে আপনারা প্লিজ পারলে দুটো টাকা এই ব্যাংকে রাখুন আপনাদের দুটো টাকায় একটা অসুস্থ বাচ্চার চিকিৎসা হবে আল্লাহ আপনাদের ভালো করবে।কি বলতে পারবে? প্রথম কয়েকবার বলার অনুশীলন করালাম তারপর মোমিনুল বলল এখন বলতে পারবো ম্যাম।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম চকলেট বিস্কুট এসব কম খেয়ে পারলে তুমি ও প্রতিদিন দুটো করে টাকা দিও? মোমিনুল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। 

হিসেব মতো প্রত্যেক ক্লাসে খোঁজ নিই মোমিনুল ঠিক মতো মাটির ব্যাংক নিয়ে আসে কিনা? এছাড়া আমি দেখেছি মোমিনুল ব্যাংকের টাকা জমানো নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকে।

সপ্তাহ দুই পরে ই মোমিনুল আমার কাছে ব্যাংকটি নিয়ে এসে বলে যে,ম্যাম ব্যাংক তো ভর্তি হয়ে গিয়েছে

! আমি অবাক হয়ে যায় এবং জিজ্ঞেস করি এতো দ্রুত ভরে গেছে? উত্তরে মোমিনুল বলল জি ম্যাম।গুড বয়! আমার লিটল মাস্টার।তাহলে আজ টিফিনে তুমি আর আমি এক জায়গায় যাবো ওকে! আচ্ছা ম্যাম।

সমাবেশে সবার উদ্দেশ্যে বললাম,তোমরা খুব দ্রুত ই এই মাটির ব্যাংক ভরে দিয়েছো এজন্য  তোমাদের সবাই কে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং দোয়া করি আল্লাহ তোমাদের সুস্থ রাখুন!  

এবার আমরা একটা সুন্দর করতালি দেই  মোমিনুলের জন্য কারণ সে দায়িত্ব টা খুব ভালো করে পালন করেছে।

মোমিনুল কে নিয়ে ইয়া'র বাসায় গেলাম তার শারীরিক অবস্থা অনেক খারাপ জানি ব্লাড ক্যান্সার কিন্তু সাথে এখন অনেক সমস্যা ও দেখা দিয়েছে। 

মোমিনুলের হাত দিয়ে মাটির ব্যাংকটা

ইয়া কে দিয়ে বললাম এটা স্কুলের বাচ্চারা তোমায় দিয়েছে।

পরের দিন স্কুলে গিয়ে দেখি মোমিনুল সবার আগেই স্কুলে এসেছে এবং আমায় এক মুঠ টাকা দিয়ে বলছে ম্যাম এইগুলো আমার টাকা তুমি ইয়া কে দিয়ে দিও।এই টা শুনে আমি একটুও অবাক হয় নাই বরং গত দুই সপ্তাহ ধরে মোমিনুলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখেছি যা আমায় মুগ্ধ করেছে।


Jane Smith

Itaque quidem optio quia voluptatibus dolorem dolor. Modi eum sed possimus accusantium. Quas repellat voluptatem officia numquam sint aspernatur voluptas. Esse et accusantium ut unde voluptas.