প্রথম বাঙালি কৃষিবিদ দ্বিজদাস দত্ত
সৃষ্টির আদি পেশা কৃষি । অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি কৃষি । কৃষি, কৃষক আর কৃষিবিদ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । বিশেষ করে কৃষিবিদ ভূমিকা অপরিসীম। নতুন প্রজন্মের কাছে ভুলে যাওয়া এমনি একজন বিস্মৃত কৃষিবিদ মনীষা হলেন দ্বিজদাস দত্ত। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি কৃষিবিদ। অবিভক্ত বাংলার এই পথিকৃৎ কৃষিবিদ ১৮৪৯ সালের অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । এখনও এই এলাকায় কালীকচ্ছ গ্রামে দ্বিজদাস দত্তের বাড়িটির অস্তিত্ব বিদ্যমান । সরাইল কলেজের মাত্র ৫০ গজ উত্তর –পূবদিকে গেলেই বিখ্যাত দত্ত বাড়ি দেখা যায় ।
দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন একাধারে কৃষিবিদ, সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক ও বিশিষ্ট লেখক । তিনি ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন সংগঠক এবং একজন সাধক পুরুষ । এই মহান পুরুষের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন ভারত উপমহাদেশর ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অগ্নিযুগের বিপ্লবী, বোমা বিশেষজ্ঞ আন্দামানের সেলুলার জেলফেরত স্বাধিনতা সংগ্রামী উল্লাসকর দত্তের (১৮৮৫-১৯৬৫) পিতা ।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর বাংলা – আসাম প্রদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন দ্বিজদাস দত্ত। এখনও তার স্মৃতি ধরে রেখেছে অধুনা রাজধানী শহর ঢাকার খামারবাড়ি (ফামগেট) সংলগ্ন বিখ্যাত ইন্দিরা রোডটি । ঐতিহাসিক ইন্দিরা রোডের নামকরণ হয়েছিল বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আমলে খামারবাড়ি এলাকায় কাজে নিয়োজিত কৃষিবিদ দ্বিজদাস দত্তের অকাল প্রয়াত কন্যা ইন্দিরা দত্তের নামে ।
কৃষিবিদ দ্বিজদাস দত্ত জন্মগতভাবে হিন্দু ধমাবলম্বী ছিলেন । পরে তিনি ব্রাহ্মধর্মের অনুসারি হন । ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)।তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন করেন। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সাহিত্যের তুলনামূলক ধর্মের আলোচনার সূত্রপাত করেন। দ্বিজদাস দত্তের মধ্যে ব্রাহ্মধর্মের বিষয়ে দারুণ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় ।
পরবর্তী কালে রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মের ব্রতে তিনি সারাজীবন কাটিয়েছেন এবং এ ধর্মের একেশ্বরবাদী নীতি প্রচার করে গেছেন । কৃষি অন্তঃপ্রাণ , মানবতাবাদী কৃষিবিজ্ঞানী দ্বিজদাস দত্ত পবিত্র কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক নরসিংদী জেলার পাঁচদোনার কৃতীসন্তান ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের (১৮৩৫-১৯১৫) সতীর্থ ছিলেন ।
দ্বিজদাস দত্ত ১৯২৯ সালে তার জন্মস্থান তৎকালীন ত্রিপুরা অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কালিকচ্ছ গ্রাম থেকে রায়তবন্ধু নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিরেন ।
কর্মজীবনে দ্বিজদাস দত্ত কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন । তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ইংল্যান্ডে কৃষিবিদ্যা অধ্যয়ন করতে গিয়েছিলেন । দেশে ফিরে এসে তিনি দীর্ঘদিন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কৃষিশাখায় অধ্যাপনাসহ বিভিন্ন কলেজের কৃষি বিভাগের অধ্যাপনার কাজ করেন ।
দ্বিজদাস দত্ত অবসর গ্রহণ করার পর অনেক গ্রন্থ রচনা করেন । তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে পাট বা নালিচা (১৯১১) অন্যতম । এই গ্রন্থটি কৃষিবিদ্যার উপর রচিত গবেষণা পুস্তক বাংলা সাহিত্য প্রথম এবং এজন্য তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার । অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ঋগ্বেদ (১৯২১), ভোটের কথা (১৯২৩), বৈদিক বন বা জাতিতত্ত্ব্ব , (১৯২৫) , কোরানের সূরা ও বেদের শ্রুতিসংগ্রহ , (১৯২৬), সর্বধর্ম সমন্বয় (১৯৩৩) উল্লেখযোগ্য ।
ইংল্যান্ড থেকে সর্বপ্রথম কৃষিবিদ্যার উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী প্রথম ভারতীয় এবং এদেশীয় বাঙালি কৃষিবিদ দ্বিজদাস দত্তের জীবনী থেকে নতুন প্রজন্মের কৃষিবিদ ও কৃষিবিদদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে ।
অধ্যাপক দ্বিজদাস দত্ত বাংলা ভাষায় মুসলমান সাহিত্য, জীবন ও সর্বধর্মের পরিচয় দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে অনেক দূর সমৃদ্ধতর করে করেছেন । তার রচনাবলি নতুন করে প্রকাশ করা দরকার । এতে জাতি উপকৃত হবে । এই মহান মনীষী ১৯৩৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন । দ্বিজদাস দত্তের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি ।